স্বর্গের সাউথ আফ্রিকায় অতীতের কিছু করুণ কাহিনী
SAPB | SOUTH AFRICA |
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবন বড়ই অনিরাপদ।দেশটির কৃষ্ণাঙ্গদের নৈরাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশীরাও একে-অপরের শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন।দিন দিন পরিস্থিতি খুব খারাপে পরিণত হচ্ছে।
নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ ধোঁকায় পড়ে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রেমিকা বা স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি কিংবা আর্থিক লেনদেন কিংবা অবিশ্বাস প্রভৃতি কারণে শত্রুতা থেকে ঘটছে প্রতিনিয়ত খুনের ঘটনা।
কখনও কখনও স্থানীয় ছিনতাইকারী ও ডাকাতের কবলে পড়েও অনেককে জীবন দিতে হচ্ছে দক্ষিন আফ্রিকায়। এভাবে প্রতি বছর দেশটিতে অধিক বাংলাদেশী খুনের শিকার হচ্ছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩২৮ টি বাংলাদেশীর লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন।তার ভিতরে সামান্য কিছু প্রবাসী অসুস্থতাজনিত মৃত্যু আর বাকি সব প্রবাসীদের হত্যা করা হয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো,এসব ঘটনায় অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে না।এর কারণ হল, খুনের ঘটনায় কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে না।আবার কোনো কোনো ঘটনায় কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে স্থানীয় তদবির ও পুলিশের অসহযোগিতায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা যায় না।দেশটির আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এতটাই নাজুক।
সংসদ সদস্য শিরিন আক্তারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে সেখানে কর্মরত প্রবাসীদের বিষয়ে এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা জানতে পারে।ওই প্রতিনিধি দলে সিআইডির এক বিশেষ পুলিশ সুপারও সাথে ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে এসে প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে সে দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি, বাংলাদেশীদের বিপন্ন জীবন এবং একের পর এক খুনের ঘটনাসহ পুরো বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবিহিত করা হয়।
সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার যুগান্তরকে বলেন,আমরা সে দেশে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে অনেক ভয়ানক তথ্য পাই।বাংলাদেশিরা সে দেশে খুব আতংকের মধ্যে আছেন।কার উপর কখন কোন বিপদ নেমে আসে, তা কেউ বলতে পারেন না।বাঙালিরা সেখানে অপহরণ ও খুনের শিকার হচ্ছেন।সফর শেষে আমরা সরকারকে বিষয়গুলো অবহিত করেছি এবং এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছি।
কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেছেন জানতে চাইলে শিরিন আক্তার বলেন, আমরা বলেছি ওই দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার।যারা সে দেশে আছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে লবিং করা উচিত।যাদের সন্তানরা সে দেশে অপরাধ করছে, তাদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।এ উদ্যোগটা সরকারই নিতে পারে।সে দেশের সরকারকে বলতে হবে, অপরাধে জড়িত বাংলাদেশীকে শনাক্ত করে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশী রয়েছেন।এদের অধিকাংশই অবৈধ পথে সে দেশে গেছেন।অবৈধ হওয়ার কারণে কৃত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলাও করা যাচ্ছে না।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ জানান,যারা দক্ষিণ আফ্রিকায় যাচ্ছেন,তাদের বেশিরভাগই অন্য দেশের ভিসা নিয়ে,বিশেষ করে মোজাম্বিকের ভিসা নিয়ে যাচ্ছেন।পরে সুযোগ মতো দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকে পড়েন।দেশী-বিদেশী একাধিক সিন্ডিকেট ‘বডিকন্ট্রাক্ট’র মাধ্যমে বাংলাদেশীকে সে দেশে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বিনিময়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়া হয়।সেখানে পৌঁছার পর আগে যারা গিয়েছে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।
কী কারণে সে বাংলাদেশীরা খুন হচ্ছেন জানতে চাইলে প্রতিনিধি দলের এ সদস্য বলেন, নতুন যেসব বাংলাদেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকছেন এবং তাদের যারা নিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যেই ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।কেউ কেউ কর্মচারী হয়ে মালিকের ব্যবসা দখল করে বসেন।এমনকি ব্যবসা নিয়ে বিরোধে একে-অপরকে ক্ষতি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।নিজেরা না পারলে কৃষ্ণাঙ্গদের দিয়ে হত্যা করানো হয়।
আবার দেখা যায়, সে দেশে যাওয়ার পর কেউ কেউ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তোলেন।এটা জানার পর ওই নারীর স্বামী বা প্রেমিক প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে খুন করেন।এসব ঘটনায় স্থানীয় পুলিশের সহায়তাও পাওয়া যায় না। তিনি জানান, সে দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় তিন দফায় আক্রমণ হয়েছে।সাবেক রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেনের বাসায় পাঁচবার ডাকাতির ঘটনা ঘটে।পরে তিনি ভয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।বাংলাদেশীদের নিরাপত্তায় পুলিশও এগিয়ে আসে না।কারণ কোনো কোনো ঘটনায় স্বয়ং পুলিশও জড়িয়ে পড়ছে।
ব্যবসায়িক বিরোধে খুন : নোয়াখালী সদর উপজেলার সুজাপুর গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে আবদুল করিম সুমন ২০১০ সালের ১১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। দেশটিতে যাওয়ার পর তিনি প্রিটোরিয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।ব্যবসাও চলছিল ভালো।২৯ আগস্ট ২০১৭ ইং তারিখ দক্ষিণ আফ্রিকার সময় রাত ১১টায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একদল কৃষ্ণাঙ্গ সন্ত্রাসী সুমনকে গলা কেটে নৃশংসভাবে খুন করে।ঘটনার সময় দোকান কর্মচারী হিরণ ওরফে শিপনের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন সুমন।
আবদুল করিম সুমনের পরিবার ১৪ বছর ধরে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী এলাকায় বসবাস করে আসছে।সুমনকে কেন হত্যা করা হল- জানতে চাইলে তার বড় ভাই আবদুস সাত্তার জানান,সুমন দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ফজলুল হকের ছেলে শাহ আলমের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করে।একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে ২০১২ সালে তারা আলাদা হয়ে যায়।এরপর সুমন একাই ব্যবসা করতে থাকে।ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বেই শাহ আলম দোকানের কর্মচারী হিরণ ওরফে শিপনের সঙ্গে আঁতাত করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সন্ত্রাসীদের দিয়ে আমার ভাইকে খুন করায়।দোকানের কর্মচারী হিরণ ওরফে শিপনের বাড়ি ও শাহ আলমের বাড়ি একই থানায়।আবদুস সাত্তার আরও জানান,২৯ আগস্ট বিকাল ৪টায় তার ভাই সুমনের সঙ্গে ফোনে তার শেষ কথা হয়।পরদিন তার কাছে ৬ লাখ টাকা পাঠানোর কথা ছিল সুমনের।কিন্তু ওই রাতেই খুন হয় সুমন।পরে তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়।
আবদুস সাত্তার আরও জানান, আমার ভাইয়ের স্টাফ ও খুনে সহায্যকারী শিপন দেশে চলে এসেছে।তার সামনেই সন্তাসীরা আমার ভাইকে গলা কেটে হত্যা করে।এ ঘটনায় দেশে কোনো মামলা করতে পারিনি।ঘটনা যেহেতু আরেক দেশে, তাই বাংলাদেশে মামলা করার সুযোগ নেই। ওই দেশে একটা অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।মামলায় কী হয়েছে,জানি না।
সুমনের মতোই ব্যবসায়িক বিরোধে বাংলাদেশীদের হাতে খুন হন দিনাজপুরের কোতোয়ালিবাগ ঈদগাহ এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মাসুদুল ইসলাম।২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান মাসুদ।এরপর সে দেশে গড়ে তোলেন নিজস্ব ব্যবসা।ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।বরিশালের মাসুদ করিম ও বেলাল নামে দুই যুবকও অবৈধ পথে সে দেশে যায়।
যাওয়ার পর তারা কোনো কাজ না পেয়ে মাসুদুল ইসলামের ব্যবসায় ভাগ বসাতে চায়।এ নিয়ে বিরোধে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ওই দুই যুবক স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের সহায়তায় মাসুদুল ইসলামকে খুন করে।পরে ৩ মার্চ তার লাশ দেশে আসে। নিহত মাসুদের ভাই বাবু যুগান্তরকে জানান,ব্যবসা গিলে খাওয়ার জন্য দুর্বৃত্ত বাংলাদেশীরা সে দেশের লোকজনকে নিয়ে আমার ভাইকে হত্যা করেছে।তারা মাসুদের দোকান ও সমিতির ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা : পপি আক্তার।গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার দেলপাড়া কলেজ রোড এলাকায়।বাবার নাম আবুল হোসেন।দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে পপি দ্বিতীয়।সুখের আশায় পপি আক্তারকে ২০০৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে দেন আবুল হোসেন।কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার হাসনাবাদ গ্রামের সৈয়দ চাঁন মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম।বিয়ের সময় দেখানো হয়েছিল শফিকুল ইসলাম ফতুল্লার পাগলা চিতাশাল এলাকায় বাড়ি করার জমি কিনেছেন এবং ব্যাংক ব্যালেন্সও আছে অনেক। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় শফিকুলের রয়েছে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি।এ কারণে সুখের স্বপ্ন যেমন পপি আক্তার দেখেছিলেন,তেমনি স্বপ্ন দেখছিলেন তার মা-বাবাও।বিয়ের পরপরই পপি আক্তারকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যান শফিকুল ইসলাম।এরপর সেখানেই তাদের কেটে যায় ৯ বছর।এর মধ্যে তাদের সংসারে আসে পিয়াল ও লাতাশা নামে দুই ছেলে সন্তান।
পপি আক্তারের মা মাজেদা বেগম বলেন,শফিকুলের ভাগিনা মো. শহিদ ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় ফোন করে আমাকে জানায়,পপি বেঁচে নেই।এক দল সন্ত্রাসী বাড়িতে হামলা চালিয়ে পপিকে গুলি করে হত্যা করেছে। শফিকুলের মাথায়ও গুলি লেগেছে।এ কথা শোনার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।ওইদিন রাত ৮টায়ও পপি আমার সঙ্গে কথা বলেছে।মৃত্যুর পর পপির লাশ দেশে নিয়ে আসে তার স্বামী শফিকুল ইসলাম।
দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে পপির বাবা আবুল হোসেন বলেন, কী কারণে প্রবাসে আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে আজও জানতে পারিনি।জামাই যা বলেছেন তাই মেনে নিয়েছি।এ ঘটনায় কোনো মামলা করিনি।কার বিরুদ্ধে কোথায় নালিশ করব,তাও তো জানি না।সরকারের কাছে বিচার চাই,যারা আমার মেয়েকে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেয়।আমরা এর তীব্রনিন্দা জানাই।
সংগ্রহীত :- যুগান্তর
Comments
Post a Comment